শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট: কলেজশিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক। ২০১৭ সাল জুড়েই আলোচনায় ছিল এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। এদের কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে, কেউ হঠাৎ করেই নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছেন। কয়েকজন নিজে নিজে বাড়ি ফিরলেও না ফেরার পাল্লাটাই ভারী। বছরজুড়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার অস্বাভাবিক ঘটনাকে কেউ কেউ ‘গুম’ বলছেন।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে এ ধরনের ৫৪৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন যার মধ্যে ৩৯৫ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিখোঁজ হয়েছেন ৫০ জন, যাদের ৩৮ জনের খোঁজ মেলেনি। মজার বিষয় হচ্ছে নিখোঁজ কিংবা অপহরণের শিকার কারও জন্যই কোনো ধরনের মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি। এদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দাবি করছে, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তাদের দলের ২০২ নেতাকর্মী গুম হয়েছেন।
এ বছরের আলোচিত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান
এ বছরের ২৭ আগস্ট ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান নিখোঁজ হন। এদিন রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে সাভারের আমিনবাজার পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের পাশে তার নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। এ ঘটনায় পল্টন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তার পরিবার। চার মাসেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
তার এই গুম হওয়ার বিষয়ে ২০ দলীয় জোটপ্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশকে গুম, খুন, অপহরণ, গুপ্তহত্যার লীলাভূমিতে পরিণত করেছে বর্তমান গণবিরোধী সরকার। ওঁৎ পেতে থাকা গুপ্তবাহিনী আমিনুরকে কোথায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে তা কেউ জানে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারীরাই তাকে গুম করেছে।
কানাডাপ্রবাসী শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ছুটি কাটাতে ঢাকায় এসেছিলেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ (২০)। গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে ধানমন্ডির স্টার কাবাবে খেতে যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন। খাওয়া শেষে আর বাড়ি ফেরেননি তিনি।
এ ঘটনায় তার বাবা জামালউদ্দিন আহমেদ ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, স্টার কাবাব থেকে চার বন্ধু স্বাভাবিকভাবে বের হয়ে যান। এরপর দুই বন্ধু একদিকে এবং ইশরাক ও আরেক বন্ধু আরেক দিকে চলে যান। এরপর ইশরাকের সঙ্গের বন্ধু তাকে রেখে অন্য দিকে চলে যান। তখন থেকে ইশরাক নিখোঁজ। চার মাস হয়ে গেলেও মেলেনি তার সন্ধান।
নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার
এ বছরের ৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে রাজধানীর আইডিবি ভবনে একটি মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য রওনা হয়েছিলেন নর্থ-সাউথ শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার। কিন্তু মিটিংয়ে আর উপস্থিত হতে পারেননি। সেই থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর জে-ব্লকের ১২/৩ সড়কের বাসা ২৫ নং নিজের বাসায় ফিরে আসেন এই শিক্ষক।
মুবাশ্বারের বাবা মোতাহার হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার রাতে কে বা কারা তাকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে একটি সিএনজি নিয়ে বাসায় পৌঁছেছেন তিনি। তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল সে ব্যাপারেও কিছু বলেনি।
মোবাশ্বার হাসান গত এক বছর ধরে বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করছিলেন। ইসলাম, রাজনীতি এবং জঙ্গিবাদ বিষয়ে সম্প্রতি তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং জার্নালে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন।
কাতার ও ভিয়েতনামের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান
কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মারুফ জামান। গত ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বাসা থেকে মেয়েকে আনতে প্রাইভেটকারযোগে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। কিন্তু বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগেই নিখোঁজ হন। সেদিন আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। পরদিন রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকা থেকে তার গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
পরদিন বাসায় ফোন দেন মারুফ জামান। বলেন, কয়েকজন লোক বাসায় আসবে। তারা তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও ডেক্সটপটি নিয়ে যাবেন। এরপর পরিবারের সঙ্গে তার আর কথা হয়নি। সেদিন দুপুরে তার মেয়ে সামিহা জামান ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেছেন। এখনো বাড়ি ফেরেননি মারুফ জামান।
সাংবাদিক উৎপল দাস
গত ১০ অক্টোবর মতিঝিল এলাকা থেকে হঠাৎ নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যান পূর্ব-পশ্চিমবিডিডটকম নামের একটি অনলাইন পোর্টালের সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাস।
নিখোঁজের দিন দুপুরে সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল উৎপলের। এরপর থেকেই তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি জিডি করেন উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস। নিখোঁজের কয়েকদিন পর টাঙ্গাইলের একটি হাসপাতালে উৎপলের সন্ধান পাওয়ার গুজব শোনা গেলেও সেখানে পাওয়া যায়নি তাকে। অবশেষে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভুলতা এলাকায় তাকে পাওয়া যায়।
‘নিখোঁজ’ ফরহাদ মজহারের ফিরে আসার রহস্য
চলতি বছরের ৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টায় নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন বিশিষ্ট লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ফরহাদ মজহার। নিখোঁজের পর তাকে অপহরণের অভিযোগ করে তার পরিবার। তবে সেদিন সন্ধ্যায় ফরহাদ মজহারকে খুলনার হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধারের পর শুরু হয় আসল নাটক। দীর্ঘ ১০ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জানায়, ‘ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছিলেন।’
এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক এ ঘটনাকে ‘নাটক’, ‘মিথ্যাচার’, ‘সাজানো গল্প’ বলে উল্লেখ করেন। ‘ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য তিনি এ ধরনের রটনা রটিয়েছেন’ বলেও দাবি করেছিলেন আইজিপি।
আর মিথ্যা নাটক সাজানোর দায়ে সম্প্রতি ফরহাদ মজহার দম্পদির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলার অনুমতি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। আদালতের অনুমতি অনুযায়ী, রাজধানীর আদাবর থানায় ফরহাদ মজহার দম্পতির বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করার কথা ছিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার।
আদালতের সিদ্ধান্ত দেখে রহস্যজনক অপহরণ ঘটনার পাঁচ মাস পর অবশেষে ডিসেম্বরের ৯ তারিখও মুখ খোলেন ফরহাদ মজহার। নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি নাটক করিনি, আমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করেছি। আদালতে দেয়া জবানবন্দি আমার না। আমাকে যা লিখে দেয়া হয়েছে, আমি তাই আদালতে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘গুম’ করার উদ্দেশ্যেই তাকে ধরে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে উদ্ধারের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে চাপ দিয়ে ও মারধর করে।
বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ অপহরণ
গত ২২ আগস্ট মঙ্গলবার বিকেল ৩টা। বনানী ওভারপাসের নিচে একটি মাইক্রোবাস থেকে থাকা বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ ও তার ছেলের পথরোধ করে। মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন এসে সাদাতকে জোর করে নামিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। মাইক্রোবাসের একজন এসে সাদাতের গাড়ির চালকের আসনে বসেন। সাদাতকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয়।
দুইটি গাড়ি কুড়িল বিশ্বরোডের তিনশ ফুট রাস্তা দিয়ে পূর্বাচলে গিয়ে থামে। সাদাতের গাড়িতে ওই সময়ও তার ছেলে মেহেদি ও কেয়ারটেকার ছিলেন। পরে পূর্বাচলে সাদাতের গাড়ি থেকে ওই ব্যক্তি নেমে যান। সাদাত ১৫ মিনিট পর ফিরে আসবেন বলে তার ছেলেকে বলে গিয়েছিলেন। তবে তখন থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন তার স্ত্রী। মামলা করা হলেও গত চার মাসে কেউ ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেনি।
অপহরণের ৭৯ দিন পর অনিরুদ্ধ রায়ের ফিরে আসা
স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়। ২৭ আগস্ট বিকেলে গুলশানের ইউনিয়ন ব্যাংকের সামনে থেকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয় তাকে। এ সময় তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক সঙ্গে ছিলেন। চালক তখন বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যদের অবহিত করেন। পরে গুলশান থানায় একটি জিডি করেন তার ভাগ্নে কল্লোল হাজরা। তবে আকস্মিকভাবে কোনো পুলিশি সহায়তা ছাড়া অপহরণের ৭৯ দিনের মাথায় অজ্ঞাত স্থান থেকে বাড়ি ফিরেন তিনি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বললেও একটি খোলা চিঠি পাঠান গণমাধ্যমের। এতে তিনি উল্লেখ করেন, তার অনুপস্থিতিতে তার অফিস থেকে জরুরি নথিপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও অপহরণ করার পর তার সব সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য নানাভাবে চাপ দেয়া হয়। ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা চেয়েছেন। তবে তিনি কোথায় ছিলেন এবং কীভাবে ফিরেছেন এ বিষয়টি এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।
বিজেপির নতুন নেতা মিঠুন চৌধুরী ও আশিক ঘোষ নিখোঁজ
২৭ অক্টোবর রাতে রাজধানী থেকে নিখোঁজ হন নবগঠিত দল বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী এবং এই জোটের নেতা আশিক ঘোষ। ওইদিন রাতে সূত্রাপুর থানার ফরাশগঞ্জে প্রিয় বল্লব জিউর মন্দির গেট লেবুপট্টি মার্কেটের সামনে থেকে একটি কালো গাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে দাবি করছে পরিবার। প্রায় আড়াই মাসেও মেলেনি তাদের সন্ধান।
নিখোঁজের সাতদিন পর ফিরলেন আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম
গত ২৩ আগস্ট থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় আইএফআইসি ব্যাংকের কর্পোরেট কমিউনিকেশন ও ব্র্যান্ডিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদের। তার পরিচিতজনরা বলেছেন, শামীম আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে থেকে ‘খানাবাসমতি’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। এরপরে তিনি আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজাখুজির পরও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ।
এ ঘটনায় পরদিন পল্টন মডেল থানায় জিডি করেন তার স্ত্রী শিল্পী আহমেদ। তবে হঠাৎ করেই সাতদিন পর ৩০ আগস্ট অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন শামীম। অন্যদের মতো তিনিও নিখোঁজের বিষয়ে সাংবাদিক কিংবা পুলিশকে কিছুই বলেননি।